শিবপুর (নরসিংদী),বর্তমানকণ্ঠ ডটকম: কাপড় ও সবজির কারণে নরসিংদীর খ্যাতি দেশজুড়ে। কিন্তু দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও নরসিংদীকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে চাষকৃত ‘কলম্বো’ জাতের সুগন্ধি লেবু। এবার শিবপুরে বারি জাতে মাল্টা চাষে করে সফলতা অর্জন করেছে অনেক কৃষক। অনেক চাষির ভাগ্য বদলে দিবে মাল্টা, আশা চাষিদের।
অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এ মাল্টা বাগানের আবাদ। চাষিদের মধ্যে মাল্টা চাষে উৎসাহের পাশাপাশি বাড়ছে বাগানের সংখ্যা।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট শিবপুরের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালে সিলেটের মৌলভীবাজার থেকে বারি মাল্টা-১ জাতের চারা এনে তারা এর পরীক্ষামূলক চাষ শুরু করে। প্রায় আড়াই বছর নানা পরিচর্যা ও গবেষণার পর প্রচুর ফলন এসেছে গাছগুলোতে।
এই জাতের মাল্টার চাহিদা ও জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলছে। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় চাষ উপযোগী
জাত না থাকায় ফলটির আশানুরূপ উৎপাদন হয় না। তবে পাহাড়ি এলাকা হিসেবে পরিচিত শিবপুর অঞ্চলে উষ্ণ জলবায়ু, মাটি উর্বর ও ক্ষারীয় হওয়ায় ফলনও ভালো হয়। এ লক্ষে ২০০৩ সালে এ জাতটি অবমুক্ত করা হয়। বারি মাল্টা-১ উচ্চ ফলনশীল ও নিয়মিত ফলদানকারী ভিটামিন সি সমৃদ্ধ। পাকা ফল দেখতে আকর্ষণীয় সবুজ এবং খেতে সুস্বাদু। মধ্য ফাল্গুন মাস থেকে মধ্য চৈত্র পর্যন্ত সময়ে মাল্টা গাছে ফুল আসে এবং কার্তিক মাসে ফল আহরণের উপযোগী হয়। ফলনের প্রথম পর্যায়ে প্রতিটি গাছে ৩০ থেকে ৫০টি ও পূর্ণাঙ্গ বয়সে ১৫০ থেকে ২০০টি ফল ধরে। আর হেক্টর প্রতি ফলন প্রায় ২০ টন।
মাল্টা চাষে অল্প খরচ, কিন্তু লাভ অনেক বেশি। তাই একদিকে যেমন এ ফলের আমদানি কমবে, তেমনি মিটবে স্থানীয় চাহিদা। আর স্থানীয় চাহিদা মেটানো সম্ভব হলে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রাও আয় হবে।
দেড় বছর আগে সিলেট জেলার জৈন্তাপুরের কৃষি গবেষণা কেন্দ্র থেকে ১৫ হাজার মাল্টার চারা আনেন শিবপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আরিফ উল ইসলাম মৃধা। শিবপুর উপজেলার ৪১ জন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার মাধ্যমে মাল্টা চাষে আগ্রহী কৃষকদের তালিকা করে বিনামূল্যে চাষিদের কাছে চারা পৌঁছে দেন।
দেড় বছর পর দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি গাছে মাল্টা ফল দোল খাচ্ছে। হাসি ফুটেছে কৃষকের মুখে। সেই শুরু। এরপর থেকেই আস্তে আস্তে শিবপুর উপজেলার তিন শতাধিক বাগানে এই মাল্টার চাষ করা হচ্ছে। ব্যক্তি পর্যায়ে রয়েছে আরও প্রায় এক হাজারের বেশি বাড়িতে মাল্টার গাছ।
ইটাখোলা মুন্সেফেরচর গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মাল্টার ফলন এত ভালো হবে এটা কখনো চিন্তাও করিনি। আমার বাগানে ৪৬টি গাছ লাগিয়েছি। একেকটা গাছে একশদ থেকে দেড়শদ ফল ধরেছে। আমাকে উপজেলা চেয়ারম্যান আরিফ মৃধা গাছগুলো বিনামূল্যে দিয়েছেন। তার দেওয়া চারায় শিবপুরে এরকম তিনশদ বাগান করা হয়েছে। সবার গাছেই কমবেশি ফল ধরেছে। মাল্টা চাষে তেমন খরচ নেই। কীটনাশক, খুটি ও শ্রমিকের খরচ বাবদ আমার প্রায় পাঁচ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। বাগানের ফলনে আমি আশা করি দুই থেকে তিন লাখ টাকা বিক্রি করতে পারব।
শিবপুরের ধানুয়া গ্রামের মাল্টা চাষি লিয়াকত হোসেন খান বলেন, আমি লেবুর বাগান করি; কিন্তু উপজেলার চেয়ারম্যান আরিফ মৃধা বললেন, মাল্টার বাগান করো, আমি চারা দেব। তার কাছ থেকে চারা নিয়ে কৃষি কর্মকর্তাদের উৎসাহে মাল্টা বাগান করি। এখন আমার বাগানে মাল্টা ধরেছে।
আয়ুবপুর ইউনিয়নের ঘাগটিয়া গ্রামের ফয়সাল খন্দকার জানান, আমি ৭২টি চারা দিয়ে দেড় বিঘা জমিতে মাল্টার বাগান করেছি। এর মধ্যে ৭১টিতেই ফল এসেছে। মাল্টার চারায় আমি স্বপ্ন দেখছি, চিন্তা করছি এ মাল্টার বাগান আরও বড় করব।
শিবপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলাম মৃধা বলেন, আমাদের দেশের মাল্টার চাহিদার পুরোটাই বিদেশি আমদানি নির্ভর । একই সঙ্গে মাল্টাকে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করতে ফরমালিনের মতো ক্ষতিকারক পদার্থ ব্যবহার করা হচ্ছে। অপরদিকে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত মাল্টা বাগানের ফলন ভাল, খেতেও সুস্বাধু। তাই আমাদের উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে মাল্টা চাষ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিই।
শিবপুর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মো. নাজমুল কবিব বলেন, শিবপুরে মাল্টার চাষে যে রকম সাড়া পড়েছে, তাতে কয়েক বছরের মধ্যেই তা হয়তো লটকন আর কলম্বো লেবুকে ছাড়িয়ে যাবে। মাত্র দেড় বছরের মধ্যেই মাল্টা গাছে ফল এসেছে। আর প্রায় ২৫ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত এতে ফল ধরবে। তাছাড়া মাল্টা বাগানে কৃষকদেরকে উৎসাহিত করতে এ উপজেলার ৪১ জন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা কৃষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাগানের খোঁজখবরও রাখছেন।
শিবপুর আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. নাজিরুল ইসলাম জানান, ফলের গুণাগুণ ও উৎপাদনের দিক থেকে মাল্টা একটি সম্ভাবনাময় ফল। অল্প জমিতে চাষের উপযোগী হওয়ায় যে কেউই বাড়িতে চাষ করতে পারবে।
শিবপুর আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা একেএম আরিফুল হক বলেন, নরসিংদীর মাটির গুণাগুণ ভালো থাকায় বারি-১ জাতের মাল্টা চাষে আমরা ব্যাপক সফলতা পাই। তাই এটি নরসিংদীসহ সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ব্যাপকভাবে কাজ করা হচ্ছে। সঠিকভাবে বারি-১ মাল্টা চাষ করতে পারলে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যাবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নরসিংদীর উপ-পরিচালক মো. আলতাফ হোসেন বলেন, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট শিবপুরের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা ে ন্দ্রে বারি-১ জাতের মাল্টা চাষ করে তাদের মধ্যে যে সফলতা এসেছে তা সারা নরসিংদীতে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এ ছাড়াও গবেষণা কেন্দ্রের এই সাফল্য চাষ উপযোগী বিভিন্ন স্থানে কৃষকদের প্রসারের জন্য কাজ করে যাচ্ছে স্থানীয় কৃষি বিভাগ। যে স্থান লেবু চাষের জন্য উপযোগী সেখানে মাল্টা চাষের জন্য চাষিদের উৎসাহিত করা হচ্ছে।