নিজস্ব প্রতিবেদক,দুর্গোৎসবের অন্যতম বর্ণাঢ্য পর্ব কুমারী পূজা। কুমারীকে দেবী দুর্গার পার্থিব প্রতিনিধি হিসেবে পূজা করা হয়ে থাকে। এছাড়াও কালীপূজা, জগদ্ধাত্রীপূজা ও অন্নপূর্ণা পূজা এবং কামাখ্যাদি শক্তিক্ষেত্রেও কুমারী পূজার প্রচলন রয়েছে।
প্রতিবছর মহাষ্টমী পূজার শেষে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়, মতান্তরে নবমী পূজার দিনেও অনুষ্ঠিত হতে পারে।
কালের অতলে দুর্গাপূজা থেকে কুমারী পূজা হারিয়ে গেলেও স্বামী বিবেকানন্দ মাতৃজাতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ১৯০১ সালে বেলুর মঠে শ্রীরামকৃষ্ণ ও মা সারদাদেবীর অনুমতিক্রমে কুমারী পূজা পুনঃপ্রচলন করেন।
তবে সব মণ্ডপে কুমারী পূজা হয় না। সাধারণত রামকৃষ্ণ মিশনের কিছু কিছু শাখায় এ পূজা মহাষ্টমীর দিনে অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর ও বরিশাল এর মধ্যে অন্যতম।
কুমারী পূজা প্রসঙ্গে ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান মহারাজ স্বামী ধ্রুবেশানন্দ বলেন, ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী দেবতাদের স্তবে প্রসন্ন হয়ে দেবী চণ্ডিকা কুমারী কন্যারূপে দেবতাদের সামনে দেখা দিয়েছিলেন। দেবীপুরাণে বিস্তারিত এ বিষয় উল্লেখ আছে। তবে অনেকে মনে করেন যে, দুর্গাপূজায় কুমারী পূজা সংযুক্ত হয়েছে তান্ত্রিক সাধনামতে। এক সময় শক্তিপীঠ সমূহে কুমারী পূজার রীতি প্রচলিত ছিল। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদেও কুমারীর কথা উল্লেখ আছে। আর এ থেকে অনুমান করা কঠিন নয় যে, দেবীর কুমারী নাম অনেক পুরনো। দেবীর কুমারী নাম যেমন পুরনো, তার আরাধনা ও পূজার রীতিনীতিও তেমনি প্রাচীন এবং ব্যাপক।’
তিনি আরো বলেন, ‘যোগিনীতন্ত্র, কুলার্ণবতন্য, দেবীপুরাণ, স্তোত্র, কবচ, সহস্রনাম, তন্যসার, প্রাণতোষিণী, পুরোহিতদর্পণ প্রভৃতি ধর্মীয় গ্রন্থে কুমারী পূজার পদ্ধতি এবং মাহাত্ম্য বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। বর্ণনানুসারে কুমারী পূজায় কোন জাতি, ধর্ম বা বর্ণভেদ নেই।’
নারীতে পরমার্থ অর্জনে কুমারী পুজা
ধ্রুবেশানন্দ বলেন, ‘দেবীজ্ঞানে যে কোনো কুমারীই পূজনীয় তবে সাধারণত ব্রাহ্মণ কুমারী কন্যার পূজাই সর্বত্র প্রচলিত। তন্ত্রসারে এক থেকে ষোল বছর পর্যন্ত ব্রাহ্মণ বালিকাদের কুমারী পূজার জন্য নির্বাচিত করা যায়। তবে অন্য জাতির কন্যাকেও কুমারীরূপে পূজা করতে বাধা নেই। কিন্তু অবশ্যই তাদের ঋতুবতী হওয়া চলবে না। ধর্মের বিধান।’
এবারের কুমারী পূজা নিয়ে বলেন, ‘কুমারী পুজা রোববার সকাল ১১টায় রামকৃষ্ণ মিশনে শুরু হবে। প্রতি বছরের ন্যায় এবারো বর্ন্যাঢ্য আয়োজন থাকবে। সনাতন শাস্ত্রে যা যা করণীয় সবই পালন করা হবে। সামাজিকভাবে কোনো বিধি নিষেধ থাকছে না পুজাতে।’
আগের বছরগুলোর কুমারীদের অবস্থা জানতে চাইলে মহারাজ বলেন, ‘ভালই আছে। তারা পড়াশোনা করছে। মাঝে মাঝে এখানে এসে পুজো দিয়ে সাক্ষাত করে যায় ‘
নারীতে পরমার্থ অর্জনে কুমারী পুজা
এদিকে কুমারী পূজার দার্শনিক তত্ত্ব নিয়ে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রঞ্জিত চক্রবত্তী বলেন, ‘কুমারী পুজা হলো নারীতে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে যে ত্রিশক্তির বলে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ক্রিয়া সাধিত হচ্ছে, সেই ত্রিবিধ শক্তিই কুমারীতে নিহিত। কুমারী প্রকৃতি বা নারী জাতির প্রতীক ও বীজাবস্থা। তাই কুমারী বা নারীতে দেবীভাব আরোপ করে তার সাধনা করা হয়। এ সাধন পদ্ধতিতে সাধকের নিকট বিশ্ব জননী কুমারী নারীমূতি সরূপ ধারণ করে। তাই তার নিকট নারী ভোগ্যা নয়, পূজ্যা।’
পৌরাণিক কল্পকাহীনিতে বর্ণিত আছে, এ ভাবনায় ভাবিত হওয়ার মাধ্যমে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিজের স্ত্রীকে ষোড়শীজ্ঞানে পূজা করেছিলেন।
কুমারী ভগবতীর দেবী দুর্গার সাত্ত্বিক রূপ। জগন্মাতা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্ঠিকর্ত্রী হয়েও চির কুমারী। কুমারী আদ্যাশক্তি মহামায়ার প্রতীক।
দুর্গার আরেক নাম কুমারী। মূলত নারীর যথাযথ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতেই কুমারী পূজার আয়োজন করা হয়। মাটির প্রতিমায় যে দেবীর পূজা করা হয়, তারই বাস্তবরূপ কুমারী পূজা। কুমারীতে সমগ্র মাতৃজাতির শ্রেষ্ঠ, শক্তি, পবিত্রতা, সৃজনী ও পালনী শক্তি, সকল কল্যাণী শক্তি সূক্ষ্ম রূপে বিরাজিতা।