নিজস্ব প্রতিবেদক,বর্তমানকণ্ঠ ডটকম: চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশ সফরে আসছেন আগামীকাল শুক্রবার (১৪ অক্টোবর)। দু’দেশের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত ২৫টিরও বেশি চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি এসব চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ ৪০ বিলিয়ন ডলার বা ৩ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকার (প্রতি ডলার ৭৮ টাকা হিসেবে) ঋণ ঘোষণার সম্ভাবনা রয়েছে বলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় সূত্রে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চীনের প্রেসিডেন্টের সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন অধ্যায় তৈরি হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অবকাঠামোগত বিভিন্ন বড় প্রকল্পে একক দেশ হিসেবে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ করেছে চীন। এতে বাণিজ্য ও অর্থনীতি, বিনিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, কৃষি, শিক্ষা ও সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে নেয়া বড় প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে।
সফরের প্রথম দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে থাকবেন দেশটির তিনজন স্টেট কাউন্সিলর, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী এবং উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশনের নির্বাহী চেয়ারম্যানসহ ২৪ সদস্যের প্রতিনিধি দল।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সফরের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করেন।
অপরদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের আমন্ত্রণে চীনের প্রেসিডেন্ট দুদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে শুক্রবার সকালে বিশেষ বিমানযোগে ঢাকায় পৌঁছানের কথা রয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফর তার তিন দেশের সফরের অংশ। তিনি কম্বোডিয়া হয়ে বাংলাদেশে আসবেন। বাংলাদেশ থেকে তিনি ভারতের গোয়ায় অনুষ্ঠেয় ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দেবেন। ঢাকা সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে শি জিনপিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
চীনের প্রেসিডেন্টের সম্মানে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রীয় নৈশভোজের আয়োজন করবেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। চীনের প্রেসিডেন্ট জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অমর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরকালে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, ব্যবসায়ী ও সাংবাদিকসহ প্রায় ২০০ জন সফরসঙ্গী থাকবেন।
ইতোমধ্যে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফর উপলক্ষে কাল শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে শনিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত বিমানবন্দর সড়কে খিলক্ষেত ক্রসিং থেকে মুনমুন কাবাব (পদ্মা ওয়েল) ক্রসিং পর্যন্ত রাস্তার পশ্চিম অংশ বন্ধ রাখা হবে।
তবে এই সড়কের পূর্ব অংশ দিয়ে যানবাহন চলাচল করবে। অবশ্য এ সময় ওই সড়কে দূরপাল্লার বাস-ট্রাক চলাচল করতে পারবে না। এসব ভারী যানবাহনকে বিকল্প সড়ক দিয়ে চলাচল করার জন্য বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
উল্লেখ্য, গত ৩০ বছরের মধ্যে চীনের কোনো প্রেসিডেন্টের এটাই প্রথম বাংলাদেশ সফর। চীন এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ৭টি সেতু ও বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র নির্মাণে সহায়তা দিয়েছে।
চীনের একটি অগ্রবর্তী প্রতিনিধি দল যেকোনো সময় চুক্তিগুলো চূড়ান্ত করবেন। যা শুক্রবার দুপুরে দুদেশের স্বাক্ষর শেষে ঋণের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হবে। চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ফজলুল করিম এ বিষয়ে ঢাকায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তার দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে এগিয়ে নিতে ‘রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভ’ নামের একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। এটি তার নিজের ‘ফ্ল্যাগশিপ’ উদ্যোগ। এর অধীনে বিশ্বের ৬৫টি দেশ চীনের সঙ্গে সড়ক ও সমুদ্রপথে সংযুক্ত হবে। বাংলাদেশও এই উদ্যোগের আওতাভুক্ত।
‘পুরনো রেশমপথ ও সামুদ্রিক রেশমপথের পুনরুজ্জীবন’ নামের এই উদ্যোগের আওতায় উপ-আঞ্চলিক কানেকটিভিটি এবং বিশ্বের দেশে দেশে অবকাঠামো উন্নয়নে হাত দিয়েছে চীন। বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারকে সংযুক্ত করে বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোর এবং সমুদ্রপথে চীন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা ও ভারতকে সংযুক্ত করা হবে। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরে ‘রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভ’এর আওতায় একটি কাঠামোগত চুক্তি সই হবে।
চীনের সহায়তায় কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের কাজ ঢাকা থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সফরে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ৭৭৪ একর ভূমিতে ‘চাইনিজ ইকোনমিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন’ (সিইআইজেড) উন্নয়নে ঋণ ঘোষণার সম্ভাবনা রয়েছে।
২০১৫-১৬ সালে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ৯ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। তার মধ্যে বাংলাদেশ আমদানি করেছে ৮ হাজার ২২৩ দশমিক ২০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আর বাংলাদেশ চীনে রফতানি করেছে মাত্র ৭৯১ দশমিক শূন্য তিন মিলিয়ন ডলারের পণ্য। বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ আট বিলিয়ন ডলারের বেশি। ‘এশিয়া প্যাসিফিক ট্রেড এগ্রিমেন্ট’ (আপটা)-এর অধীনে বাংলাদেশ চীনের বাজারে ৪ হাজার ৭২১টি পণ্য রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে থাকে।
এদিকে চীনের পক্ষ থেকে দু’দেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সফরকালে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির প্রভাব ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ঘোষণা দেয়া হতে পারে। এ চুক্তি হলে এটি হবে বাংলাদেশের সঙ্গে পৃথিবীর কোনো দেশের প্রথম দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি।
প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরকালে সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে মেরিন ড্রাইভওয়ে এবং উপকূল সুরক্ষা প্রকল্প বিষয়ে চুক্তি সই হতে পারে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ব্যক্তিগত আগ্রহে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। তথ্য-প্রযুক্তি খাতেও বড় অঙ্কের ঋণ সহায়তার ঘোষণা দেবে চীন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) নতুন ৪টি স্টেশন করার প্রস্তাবেও ইতিবাচক সাড়া রয়েছে। ঢাকায় একটি বৃহৎ বর্জ্য শোধনাগার প্রতিষ্ঠায়ও আগ্রহী তারা। পায়রা বন্দরে মেগা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজও পেতে যাচ্ছে চীন।