নিজস্ব প্রতিবেদক,বর্তমানকণ্ঠ ডটকম: নৌযান থেকে নদ-নদীর পানিতে পড়া ৫০ হাজার ৪শ মেট্রিক টন মনুষ্য বর্জ্য নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের দু’টি সংস্থা। নিয়ন্ত্রণকারী দুই সংস্থা শুধু চিঠি চালাচালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। দোষ চাপাচ্ছে একে অপরের কাঁধে। মূলত নৌ পরিবহণ অধিদফতর এবং বিআইডব্লিউটিএ-এর সমন্বয়হীনতার কারণে দূষিত হচ্ছে নদীর পানি, ছড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের পানিবাহিত রোগ।
আইনে বলা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ নৌপথে কোনো নৌযান চলাচল করতে পারবে না, যদি সে নৌযানের (ফেরি, স্টিমার লঞ্চসহ অন্যান্য) পূর্ণাঙ্গ স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকে। এটি পরিবেশ ও পানি দূষিত করতে পারে। এছাড়া পানিতে কোনো প্রকার তৈলাক্ত পদার্থ বা তৈল মিশ্রিত উপকরণ, বা স্যুয়ারেজের ময়লা ফেলা যাবে না- যা পানিকে দূষিত করতে পারে। আর এটি নিয়ন্ত্রণ করবে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।
প্রায় এক বছর আগে (গত বছরের ৮ নভেম্বর) স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি দিয়েছে নৌ পরিবহণ অধিদফতরকে। চিঠিতে বলা হয়েছে, নৌযান থেকে নির্গত মনুষ্য বর্জ্য এবং পোড়া তেল সরাসরি পানিতে ফেলা হচ্ছে। এতে করে পানি দূষিত হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশও নষ্ট হচ্ছে। বিভিন্ন নৌরুটে প্রতিদিন প্রায় ৫-৭ লাখ মানুষ চলাচল করে। এসব মানুষ যারা পানিতে মলমূত্র ত্যাগ করেন। একারণে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হয়েছে।
এ চিঠির প্রেক্ষিতে গত ১৪ ডিসেম্বর নৌ পরিবহণ অধিদফতরের মহাপরিচালক নৌযানে বর্জ্য ধারণের জন্য ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ দিতে অনুরোধ করে একটি চিঠি দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশ-১৯৭৬ ও এর সংশোধনী ২০০৫-এর (৬০ক) ৪ ধারা অনুযায়ী নৌযান থেকে অভ্যন্তরীণ নৌপথে তৈলজাতীয় বর্জ্য এবং পয়:বর্জ্য ফেলা নিষিদ্ধ।
এমতাবস্থায় নৌযান যাত্রীদের মলমূত্র হতে সৃষ্ট তরল বর্জ্য নৌযানের অভ্যন্তরে পরিশোধনের ব্যবস্থা এখনও গড়ে তোলা হয়নি। ফলে নদী ও পানি দূষণ রোধকল্পে নৌযানের বর্জ্য সংগ্রহ করার জন্য দেশের নৌবন্দর সমূহে বর্জ্য সংগ্রহের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের চিঠি থেকে জানা গেছে, দেশে প্রতিদিন ৫-৭ লাখ মানুষ নৌ পথে চলাচল করে। এ হিসাবের উপর ভিত্তি করে ৭ লাখ মানুষ (প্রতি জন ২০০ গ্রাম) নদীতে মলমূত্র ত্যাগ করলে প্রতিদিন এক লাখ ৪০ হাজার কেজি বা ১৪০ মে. টন বর্জ্য নদীতে পড়ছে, যা মাসের হিসেবে ৪২০০ মে. টন এবং বার্ষিক ৫০হাজার ৪শ মে. টন। এর সঙ্গে খাদ্য ও ফলের উচ্ছিষ্টাংশ এবং শিল্প বর্জ্য যোগ করলে এর পরিমাণ প্রায় তিনগুণ হবে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ‘নৌপথে চলাচলকারী সব ধরনের নৌযানে স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (এসটিপি) স্থাপন বাধ্যতামূলক করার জন্য নৌ পরিবহণ অধিদফতরকে আহ্বান জানানো হয়েছে।’
দেশের নৌবন্দরগুলোর ফ্যাসিলিটির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বর্জ্য অপসারণের দায়িত্ব বিভিন্ন সিটি করপোরেশনের। তবে বন্দরগুলো থেকে বর্জ্য যাতে সিটি করপোরেশন সংগ্রহ করতে পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা নৌ পরিবহণ অধিদফতরকে বলেছি, নৌযানে এসটিপি না বসালে নৌ চলাচলের জন্য (বার্ষিক সার্ভে সনদ) অনুমোদন না দিতে। আর নতুন করে এসটিপি ছাড়া কোনো নৌযানের নকশা অনুমোদন না করার জন্যও বলা হয়েছে।’
নৌ পরিবহণ অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী একেএম ফখরুল ইসলাম জানান, অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলকারী নৌযানের ময়লা সংরক্ষণের জন্য প্রতিটি নৌযানে ডাস্টবিন রয়েছে। তবে নৌযাত্রীদের ত্যাগ করা মলমূত্র ধারণ করার জন্য প্রয়োজনীয় কিট বা উপকরণ সংযোজন করা নেই। ফলে ময়লাগুলো সরাসরি নদীতে পড়ছে। বিষয়টি নৌযান মালিকদের জানানো হয়েছে। পাশপাশি এ জন্য তারা বিআইডব্লিউটিএ-কে অনুরোধ জানিয়েছে। বর্জ্য অপসারণ নিশ্চিত করা হলেই তারা মালিকদের এ ধরনের কিট বসানোর জন্য জোর দিতে পারে।
বিআইডব্লিউটিএ-এর পরিচালক (বন্দর ও পরিবহণ)বলেন, ‘নৌযানের নকশা অনুমোদনের সময়েই নৌ পরিবহণ অধিদফতরকে মনুষ্য বর্জ্য সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় কিট স্থাপন বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। তা না হলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে না। এছাড়াও নদী দূষণের অন্যান্য উৎস মুখ বন্ধ করা প্রয়োজন। নৌযানের মাধ্যমে পানি দূষণ খুবই কম, এর হার বেশি হলে ৩ অথবা ৪ শতাংশ। শিল্পের মাধ্যমেই বেশি (৬০ শতাংশ) দূষণ হয়ে থাকে। তবে কিছু কিছু বন্দরে নৌযানে বসানো ডাস্টবিন থেকে বর্জ্য অপসারণের ব্যবস্থা রয়েছে।’
নৌ পরিবহণ অধিদফতরের প্রধান পরিদর্শক (চলতি দায়িত্ব) শফিকুল ইসলাম জানান, শুধু নৌযানের নকশা পরিবর্তন বা এসটিপি স্থাপন করলেই হবে না। এসব মনুষ্য বর্জ্য অপসারণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। বর্জ্য অপসারণের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। বিআইডব্লিউটিএ-কেও বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-এর চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ‘নৌ নিরাপত্তা সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সভায়ও নৌপথের দূষণ রোধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার কথা বার বার বলা হয়েছে। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএ এ কাজে ব্যর্থ হয়েছে। নদীতে চলাচলকারী নৌযানের বর্জ্য অপসারণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে পারেনি। তাদের পক্ষ থেকে নৌযানে ডাস্টবিন করার জন্য বলা হলেও সব নৌযানে ডাস্টবিন এখনো বসানো হয়নি। মলমূত্র সংরক্ষণের জন্যও লঞ্চের অভ্যন্তরে বিজার্ভার স্থাপন করা প্রয়োজন। তাও বাধ্যবাধকতার মধ্য আনতে পারেনি সরকারি এ সংস্থাটি।’
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ (যাপ) পরিবহণ মালিক সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি আলহাজ বদিউজ্জামান বাদল জানান, নদী ও পানি দূষণ রোধে সরকার আমাদের যা করতে বলবে, আমরা তাই করব। তবে আমাদের একতরফাভাবে দোষ দিলে হবে না। নৌযানের যাত্রীরা নদী দূষণ করেছে ঠিকই, কিন্তু এর থেকে পরিত্রাণের উপায় আমরাও চাই। তবে এ ধরণের বর্জ্য অপসারণ সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যাদের দায়িত্ব রয়েছে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করছে না। আমরা আমাদের নৌযানে এসটিপি স্থাপন করব, কিন্তু এসটিপি থেকে বর্জ্য অপসারণের নিশ্চয়তা না পেলে আমরা সেটি করব না।