1. khandakarshahin@gmail.com : bangla :
  2. cmi.sagor@gmail.aom : cmi Sagor : cmi Sagor
মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:৫০ পূর্বাহ্ন
বর্তমানকণ্ঠ :-
Welcome To Our Website...



আমাকে নয়, সুরকার-গীতিকারদের চিনুন

Reporter Name
  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৬
  • ২১০ Time View

imageনিউজ ডেস্ক,বর্তমানকণ্ঠ ডটকম: অনুষ্ঠান শুরু হতে খানিকটা দেরি। প্রধান শিল্পী মান্না দে। গীতিকার মিল্টু ঘোষ ভাবলেন, মান্নাদার সঙ্গে একটু দেখা করে আসা যাক। কিন্তু কর্মকর্তারা কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না। এত বড় শিল্পী! যদি বিরক্ত হন! মিল্টুবাবু ফিরেই আসছিলেন। মান্নাদা বোধহয় ঘর থেকে দেখতে পেয়েছিলেন।

নিজেই ডাকলেন মিল্টুবাবু আর সেই কর্মকর্তাকে। আয়োজক সেই ভদ্রলোককে মান্নাদা বললেন, ‘‘যাঁকে আসতে দিচ্ছিলেন না, তাঁকে কি আপনি চেনেন? অবশ্যই চেনেন না, সে তো আমি বুঝতে পারছি। চিনতে পারলে তো ওনাকে সসম্মানে এখানে নিয়ে আসতেন।’’ তারপর মিল্টুবাবুকে দেখিয়ে কর্মকর্তাটিকে বললেন, ‘‘এই যে আপনারা অনুষ্ঠান করছেন, আমাকে গাইতে ডাকছেন, সেটা কিন্তু এই ভদ্রলোকের জন্য।’’ কর্মকর্তাটি অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। মান্নাদা বললেন, ‘‘ওনার নাম মিল্টু ঘোষ। দারুণ দারুণ সব গান লেখেন। সেই সব গান আমরা গাই। সেসব গান আপনাদের ভাল লাগে বলেই তো আমাদের ডাকেন আপনারা।

আমরা যে গানগুলো গাই, সেগুলো তো আকাশ থেকে পড়ে না! গীতিকার-সুরকাররা গানগুলো তৈরি করে দেন। ওদের কন্ট্রিবিউশন অনেক বেশি। ওদের উপযুক্ত সম্মান জানাতে শিখুন। আপনারা মশায় শুধু শিল্পীদের নিয়েই মাতামাতি করেন।’’

মান্নাদা এ কথা বারবার বলতেন। গানের মূল স্রষ্টাদের জন্য তাঁর খুব শ্রদ্ধা ছিল। শুধুমাত্র কিছু কর্মকর্তা বা শ্রোতাদের কথা বলি কেন! অনেক শিল্পীকেও দেখেছি তাঁরা তাঁদের সব গানের গীতিকার-সুরকারদের নাম মনে রাখতে পারেন না, বা মনে রাখতে চান না। অনেকে তো ‘মিল্টু ঘোষ’কে অম্লানবদনে ‘মিন্টু ঘোষ’ বলেন। ভেবে দেখুন, কী সমস্ত অসাধারণ গান রচনা করেছেন মিল্টু বাবু। সেগুলো একটু বলি—‘এক তাজমহল গড়ো হৃদয়ে তোমার’ (গায়ক পিন্টু ভট্টাচার্য), ‘শঙ্খ বাজিয়ে মা-কে ঘরে এনেছি’ (সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়), ‘জীবনের অনেকটা পথ একেলা চলে এসেছি’, ‘ও আকাশ সোনা সোনা’, ‘পৃথিবীটা যেন এক মজার অঙ্ক এই পৃথিবী’ (তিনটি গানই গেয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়), ‘কেন জানি না গো শুধু তোমার কথা মনে পড়ে’ (মৃণাল চক্রবর্তী), ‘সেই চোখ কোথায় তোমার’ (মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়), ‘কখনও নদীর তীরে সন্ধ্যা নামবে ওগো’ (বিশ্বজিৎ)। এ তো সামান্য দু’একটা ঝলক। আমরা শুধু গায়ককেই মনে রাখি। গান শুধু তাঁরই হয়ে যায়। যেমন, মান্না দে-র গান, হেমন্তের গান, সন্ধ্যার গান। মান্নাদা কিন্তু তাঁদের স্মরণ করেছেন সব সময়। অনুষ্ঠানে গীতিকার-সুরকারদের নাম জানিয়ে গান শুরু করতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল—দে আর প্রডিউসার্স, উই আর রি-প্রডিউসার্স।

মান্নাদার একটি অতি-বিখ্যাত গান ‘তুই কি আমার পুতুল পুতুল সেই ছোট্ট মেয়ে’। মেয়ের বিয়ের দিন। বাবা অবাক হয়ে দেখছেন আর ভাবছেন, সেই ছোট্ট মেয়ে কবে এত বড় হয়ে গেল! বাবা-মায়ের সেই চিরন্তন ভালবাসার কথা। গানের কথা পড়ে মান্নাদার ভীষণ ভাল লাগল। ভাল তো লাগবেই। তিনিও দুটি কন্যাসন্তানের পিতা। তাদের বিয়ে হওয়ার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে মান্নাদার। বুকের ভিতর এক অদ্ভুত যন্ত্রণা। ঘর থেকে মেয়ে চলে যাবে। সেই মুহূর্তে বাবার মনে পড়ে যায় ছোটবেলার দিনগুলো।

সুপর্ণকান্তি ঘোষ মান্নাদার অন্যতম প্রিয় সুরকার। মান্নাদার বহু কাহিনিমূলক গানে অসাধারণ সুর করেছেন তিনি। যেমন, কফি হাউস, ছোট বোন, দশ বছরের বংশী, খেলা ফুটবল খেলা। মিল্টুবাবুকে বললেন, ‘‘গানটা খোকা (সুপর্ণকান্তি ঘোষ)-কে দিন। দেখবেন কী দারুণ সুর করবে!’’ কিন্তু ঘটনা এমন ঘটল, গান আর এগোচ্ছে না। সুপর্ণর কাজের ধারা একটু অন্যরকম। গীতিকারকে দিয়ে লেখাটা অনেক বার ঘষামাজা করান, যাতে বেটার কিছু পাওয়া যায়। আমি শুনেছি, ‘কফিহাউসের সেই আড্ডা’র শেষ স্তবক গৌরীবাবুকে বহু বার লিখতে হয়েছিল। তবে এ কথা ঠিক, শেষ পর্যন্ত গানের শেষ যে-লাইনগুলো সুপর্ণর পছন্দ হয়, বাংলা গীতিসাহিত্যে তা অমর হয়ে রয়েছে।

আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। একটা গানের লেখা বহু মাস ধরে পরিবর্তন করে করে ফাইনালি যখন সুপর্ণর অ্যাপ্রুভাল পেল, দেখলাম ফেলে দেওয়া লাইনগুলি দিয়েই আরও নতুন দুটো গান তৈরি হয়ে গেছে। নিজেও দেখলাম সুপর্ণর জন্য পরিবর্তিত লিরিকটা অনেক ম্যাচিওর্ড লাগছে।

যাই হোক, মিল্টুবাবুর লেখা ‘তুই কি আমার…’ পড়ে সুপর্ণর মনে হল, লিরিকের কয়েকটা জায়গা পরিবর্তন করতে হবে। বললেনও সে কথা। কিন্তু মিল্টুবাবুর আবার মনে হয়েছে, ওই চেঞ্জগুলোর প্রয়োজন নেই। ব্যাপারটা এখানেই থেমে থাকল। শেষ পর্যন্ত মুশকিল আসান হয়ে এলেন মান্নাদা। মিল্টুবাবুর কাছে ফোন গেল, মদন ঘোষ লেনে একবার আসতে হবে। যথা আজ্ঞা। মিল্টুবাবু এলে মান্নাদা বললেন, ‘‘মিল্টুবাবু, গানটা শুনুন তো! আমি নিজেই একটু সুর করার চেষ্টা করেছি। দেখুন তো কেমন লাগছে!’’ মান্নাদা গাইতে লাগলেন—‘তুই কি আমার পুতুল পুতুল সেই ছোট্ট মেয়ে।’ গান শেষ হতে মতামত দেওয়ার পরিস্থিতি আর রইল না। দু’জনেরই চোখে জল। কণ্ঠরুদ্ধ।

মান্নাদার না-হতে-হতে হয়ে যাওয়া আর একটা কালজয়ী গানের কথা বলি। ‘চৌরঙ্গী’ ছবির গান। ‘বড় একা লাগে এই আঁধারে।’ মিল্টু ঘোষের লেখা। সুরকার অসীমা মুখোপাধ্যায়। তিনি আবার সেই ছবির প্রযোজিকা। গান শুনে কিন্তু পরিচালক পিনাকী মুখোপাধ্যায়ের একদম পছন্দ হল না। স্যাটা বোসের নিঃসঙ্গ মানসিকতায় নাকি গানটা খাপ খাচ্ছে না। কথা এবং সুরও ভাল লাগছে না। সবার মন খারাপ হয়ে গেল। সুরকার তো নিজেই এই ছবির প্রোডিউসার। সে সময় কিন্তু পরিস্থিতি অন্য রকম ছিল। কিছু চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটাই ছিল না। শেষ পর্যন্ত বাঁচালেন উত্তমকুমার। ভাগ্যিস বাঁচিয়েছিলেন। গানটি শুনে উত্তমকুমার পরিচালককে বললেন, ‘‘আপনি হাজারটা গান তৈরি করাতে পারেন, আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, এর থেকে কোনও গানই ভাল হবে না।’’ পরিচালক আর কোনও কথা বললেন না। স্যাটা বোসের বেদনা-নির্ভর এই গানটি যখন মান্নাদা গাইলেন, তখনই এই গানটির ভবিষ্যৎ লেখা হয়ে যায়।

মে মাসে অর্থাৎ মান্নাদার জন্মমাসে অনেকগুলো অনুষ্ঠান অ্যাটেন্ড করেছি। প্রতিটি অনুষ্ঠানে শুনলাম কেউ না কেউ এই গানটি গাইছেন। রূপঙ্করকে তো তিনটি অনুষ্ঠানে এই গানটা গাইতে শুনলাম। শুধু পিনাকী মুখোপাধ্যায়কে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সঙ্গীত নির্বাচনে তাবড় তাবড় মানুষও কিন্তু প্রাথমিক স্তরে ধোঁকা খেয়েছেন। ‘মধুমতী’ ছবির কথা ভাবুন। ১৯৫৮ সালের এই ছবিকে আমরা মনে রেখেছি তার অসামান্য গানগুলির জন্যও। রাজকপূরকে তাঁর অসম্ভব সংগীত-বোধের জন্য আলাদা ভাবে শ্রদ্ধা করতেন মান্নাদা। ‘মধুমতী’র গান রেকর্ডিঙের পর গানগুলি রাজকপূরকে শোনানো হয়, তাঁর মতামতের জন্য। একটা গানও রাজকপূরের পছন্দ হল না। পরিচালককে পরামর্শ দিলেন অন্য কাউকে দিয়ে গানগুলির সুর করাতে। ভাবলে শিউড়ে উঠতে হয়, পরিচালক বিমল রায় যদি সে কথা শুনতেন, তাহলে কী হত? ব্যর্থতার বোঝা মাথায় নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসতে হতো সলিল চৌধুরীকে। সংগীত-প্রেমিকরা শুনতে পেতেন না ‘মধুমতী’ ছবির কালজয়ী সব গান। মান্নাদার গুণগ্রাহীরা বিশেষ করে মিস করতেন লতাজির সঙ্গে তাঁর সেই বিখ্যাত ডুয়েট—‘ও বিজুয়া, পিপল ছেয়া বৈঠি’।

মান্নাদার হিউম্যান স্টাডি ছিল অব্যর্থ। একবার কয়েক জন ভদ্রলোক এসেছেন। মিল্টু ঘোষের গানের একটা সংকলন প্রকাশিত হচ্ছে। মান্নাদা যদি একটা ভূমিকা লিখে দেন। বাংলায় লিখতে হবে শুনে মান্নাদা বললেন, ‘‘এখনই আমার লেখা মুশকিল। লিখে রাখব। পরে পাঠালে হবে?’’ তাদের একটু তাড়া ছিল। অনেক কষ্টে মান্নাদার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছে। আমি মান্নাদাকে বললাম, ‘‘কী লিখতে হবে যদি বলে দেন আমি লিখে দেব? আপনি পড়ে নিয়ে সই করে দেবেন।’’ মান্নাদা বললেন, ‘‘তাহলে তো খুব ভাল হয়। আপনি এই কথাটা গুছিয়ে লিখুন— মিল্টুবাবু একজন অতি-ভদ্রলোক। ভিড় দেখলেই পিছনে দাঁড়িয়ে থাকেন। সামনে আসার জন্য গুঁতোগুঁতি করেন না। এই জন্য ওর লেখা গান সব মানুষই জানেন, ওঁকে না চিনলেও।’’ এত কম দেখেও মান্নাদা মিল্টুবাবুকে কী করে বুঝলেন?

মহাজাতি সদনে মান্নাদার অনুষ্ঠান। একটি গান গাওয়ার আগে মান্নাদা বললেন, ‘‘জানেন, এই মুহূর্তে আমার বড় একা লাগছে। কেন জানেন?’’ দর্শকাসনে বসেছিলেন মিল্টু ঘোষ। সেদিকে তাকিয়ে মান্নাদা বললেন, ‘‘মিল্টুবাবু একটু আমার পাশে এসে বসলে আর একা লাগবে না। ওনার লেখা গান তো!’’

মান্নাদার না-বলা কথাটা হল—শুধু আমাকে নয়, গানের স্রষ্টাকেও তো চিনতে হয়!

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category

প্রধান সম্পাদক
মফিজুল ইসলাম চৌধুরী সাগর

© All rights reserved © 2021 Jee Bazaar |
Theme Customized BY WooHostBD