চট্টগ্রাম,বর্তমানকণ্ঠ ডটকম: কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধ বিহার ও বসতিতে হামলার চার বছর আজ। এই চার বছরে সরকারী-বেসরকারী সহায়তায় ঘুরে দাঁদিয়েছে ক্ষতিগ্রস্তরা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে যে আস্থার সংকট তৈরী হয়েছিল তা অনেকটা পুষিয়ে গেছে। নতুন বিহার, ঘরবাড়ী নির্মাণ হওয়ায় সন্তুষ্ট বৌদ্ধপল্লির বাসিন্দারা।
তবে, আইনী কার্যক্রম নিয়ে অসন্তোষ কাটেনি ক্ষতিগ্রস্থদের। প্রকৃত অপরাধীদের বেশিরভাগ আইনের আওতায় আনা হয়নি। মূল ঘটক উত্তম বড়ুয়ার খোঁজ মেলেনি চার বছরেও। মামলা-মোকদ্দমাগুলোর বিষয়ে কিছুই জানেনা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতারা। মামলায় কাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, কাকে বাদ দেয়া হয়েছে সে বিষয়ে তাদের অন্ধকারে রাখা হয়েছে।
কক্সবাজার কোর্ট পুলিশের পরিদর্শক রঞ্জিত পালিত জানান, ১৯টি মামলার মধ্যে জনৈক সুধাংশু বড়ুয়ার দায়ের করা মামলাটি আপোষ-মিমাংসামূলে নিষ্পত্তি করা হয়েছে। বাকি মামলার মধ্যে তিনটি মামলা অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেষ্টিগেশন পিবিআইকে দেওয়া হয়েছে। বাকি মামলাগুলো বিচারাধীন রয়েছে।
প্রসঙ্গত: উত্তম বড়ুয়া নামের এক বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুকে পবিত্র কোরান শরীফ অবমাননার অভিযোগ এনে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামুর ১২টি বৌদ্ধ বিহার, ২৬টি বসতঘরে অগ্নিসংযোগ ও হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এ সময় আরো ছয়টি বৌদ্ধ বিহার এবং শতাধিক বসতঘরে হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুর চালানো হয়। পরদিন (৩০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে উখিয়ায় আরো চারটি বৌদ্ধ বিহারে হামলা চালানো হয়েছে।
জেলা পুলিশ সুত্রে জানা গেছে,রামু উখিয়া ও টেকনাফে সহিংসতার ঘটনায় ১৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে রামু থানায় ৮টি, উখিয়ায় ৭টি, টেকনাফে দুইটি ও কক্সবাজার সদর থানায় দুইটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে ১৫ হাজার ১৮২ জনকে। এর মধ্যে এজাহারভুক্ত আসামী করা হয় ৩৭৫ জন। পরবর্তীতে এসব মামলায় ৯৪৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। এর মধ্যে রামুর ৮টি মামলায় ৪৫৮ জনকে অভিযুক্ত করা হয় ।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেষ্টিগেশন (পিবিআই) কক্সবাজার এর পরিদর্শক জাবেদুল ইসলাম ও কৈশানু মার্মা জানান, কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের উখিয়ারঘোনা জেতবন বৌদ্ধ বিহার,লট উখিয়ারঘোনা জাদীপাড়া আর্য্যবংশ বৌদ্ধ বিহার, ফতেখাঁরকুলের লালচিং, সাদাচিং ও মৈত্রী বিহার এবং চাকমারকুল ইউনিয়নেরর অজান্তা বৌদ্ধ বিহারে হামলার ঘটনায় রুজু হওয়া তিনটি মামলা আদালত থেকে অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআই-এর কাছে পাঠানো হয়েছে। ইতিমধ্যে তদন্তকাজ শেষ করে জেতবন বৌদ্ধ বিহার,লট উখিয়ারঘোনা জাদীপাড়া আর্য্যবংশ বৌদ্ধ বিহারের মামলাটি অভিযোগ পত্রও পুনরায় আদালাতে প্রেরণ করা হয়েছে। তারা জানান, এ মামলায় প্রথমে ৭০জনকে অভিযুক্ত করে পুলিশ আদালতে অভিযোগ পত্র জমা দেয়। অধিকতর তদন্ত শেষে এ মামলায় অভিযুক্তের তালিকায় নতুন আরো ২৬ জনসহ ১০৬জনকে অভিযুক্ত করে সম্প্রতি আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মমতাজ উদ্দিন বলেন, মামলাগুলোর বিচার কার্যক্রম অনেকটা শেষ পর্যায়ে। তবে এসব মামলায় স্বাক্ষী যারা, তারা বেশিরভাগই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের। তারা ভয়ে কেউ স্বাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছেননা। একটি মামলায় ১২ কি ১৩ জন আদালতে স্বাক্ষ্য দিলেও এদের মধ্যে ৯জন স্বাক্ষীকে বৈরী ঘোষনা করেছেন আদালত। ঘটনার প্রত্যক্ষ্যদর্শী এবং ভুক্তভোগী যারা তারা যদি স্বাক্ষ্য না দেন, তাহলে অপরাধীরা পার পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।
তিনি জানান, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অনেকের সঙ্গে আমি যোগাযোগ করেছি,তারা কোনো ধরনের সহযোগিতা করছেন না। সব দিক বিবেচনা করেই তিনটি মামলা পুনঃ এবং অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআই-এর কাছে পাঠানো হয়েছে। আরো দুটি মামলা অধিকতর তদন্তের জন্য প্রক্রিয়াধীন আছে।
রামু উপজেলা কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ ঐক্য ও কল্যাণ পরিষদ ও রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের সাধারণ সম্পাদক তরুন বড়ুয়া বলেন, ১৯টি মামলার বাদি পুলিশ। পুলিশ ইচ্ছেমত আসামি করেছে। ইচ্ছেমত বাদ দিয়েছে। এমনকি সেদিনের হামলায় যারা মিছিলের সামনের সারিতে ছিল, যারা ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগে নেতৃত্ব দিয়েছে এরা কেউই পুলিশের অভিযোগপত্রে নেই। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে পুলিশকে বার বার তাগিদ দেওয়া স্বত্বেও প্রকৃত অপরাধীদের অনেকের অভিযোগপত্রে নাম আসেনি। ফলে আইনগত পুরো বিষয়টি নিয়ে অন্ধকারে আছে বৌদ্ধ সম্প্রদায়। এ অবস্থায় বর্তমানে ভয়ে স্বাক্ষীরাও স্বাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছেন না। সবমিলে মামলাগুলোর হ-য-ব-র-ল অবস্থা।
তিনি বলেন, ঘটনার পর থেকে সরকার এবং সেনাবাহিনীর কাছ থেকে অনেক সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে। নতুন নতুন বৌদ্ধ বিহার ও বাড়ি ঘর নির্মানসহ পুণর্বাসনের বিষয় নিয়ে সরকারের প্রতি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। বর্তমানেও সরকারের পক্ষ থেকে নানা সহযোগিতা অব্যাহত আছে। কিন্তু প্রকৃত অপরাধীদের অনেকেই আইনের আওতায় না আসায় অসন্তোষ কাটছেনা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের।
রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের আবাসিক পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, এই চার বছরে আমরা ভাঙ্গা-গড়া,উত্থান পতন অনেক কিছুর মুখোমুখি হয়েছি। এ ঘটনায় রামুর হাজার বছরের গর্বের ধন ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে’ যে আস্থার সংকট তৈরী হয়েছিল এ চার বছরে তা অনেকটা কেটে ওঠেছে। তবে এ অবস্থায় সুষ্ঠু বিচারের পাশাপাশি সম্প্রীতির জায়গাটাকে আরো বেশী সমৃদ্ধ করতে হবে। সেটি হতে পারে সামাজিক ভাবে, রাষ্ট্রিয় ভাবে বা আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।
বিচার বিভাগীয় তদন্তের শুনানীর কোনো অগ্রগতি নেই: ঘটনার পর পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের তদন্ত কমিটি এবং চট্রগ্রামের দায়রা জজ আবদুল কুদ্দুস মিয়ার নেতৃত্বে বিচার বিভাগীয় দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের প্রতিবেদনে ২০৫ জন অভিযুক্ত করে একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়। বিচার বিভাগীয় তদন্তেও ২৯৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয় প্রায় চার বছর আগে। কিন্তু চার বছর আগে বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হলেও মূল মামলার চুড়ান্ত শুনানীর কোনো অগ্রগতি নেই।
রামু সহিংসতা স্মরণে সংঘদান, মৈত্রীর্যালী ও ধর্মসভা: এদিকে বিভীষিকাময় রামু সহিংসতার চার বছর অতিক্রান্তে রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদ শ্রীকুল লাল চিং-মৈত্রী কমপ্লেক্স চত্ত্বরে দিনব্যাপী কর্মসূচী গ্রহণ করেছে।
কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে সকাল ৮টায় জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ১০টায় সংঘদান ও অষ্ট উপকরণ দানসভা, বেলা বারটায় অতিথি ভোজন, দুপুর ২টায় মৈত্রীর্যালী, ৩টায় ধর্মসভা এবং বিকাল ৫টায় দেশ ও বিশ্বশান্তি কামনায় হাজার প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও সমবেত প্রার্থনা।
স্মরণানুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন বাংলাদেশি বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু দ্বাদশ সংঘরাজ ড. ধর্মসেন মহাথের।
সভাপতিত্ব করবেন একুশে পদক প্রাপ্ত রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের অধ্যক্ষ, উপসংঘরাজ পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের।