লক্ষন বর্মন,বর্তমানকণ্ঠ ডটকম: নরসিংদী জেলা পরিষদ নির্বাচনে ৯৯৩ ভোটারই আছেন এখন ফুরফুরা আমেজে। রাজনৈতিক ভাবে এর আগে এত কদর কখনওই পাননি তারা। কারন এবার রাজনৈতিক ভাবে আধিপত্য ও মনস্তাত্বিক যুদ্ধে নেমেছেন আওয়ামীলীগের একজন সাবেক মন্ত্রী ও অপরজন বর্তমান প্রতিমন্ত্রী। এতে প্রায় প্রতিদিনই ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভোটারদের দ্বারে দ্বারে কড়া নাড়ছেন জেলা আওয়ামীলীগের কোন না কোন বড় নেতা। তাদের সাথে জোটবদ্ধ হয়েছেন আওয়মীলীগের ত্যাগী ও হাইব্রিড নেতা-কর্মীরা। দলীয় নেতাদের আকস্মিক মূল্যায়নে ভোটাররাও মহা খুশি।
তারা বলছেন ভোট যুদ্ধ হবে এবার সেয়ানে সেয়ানে। ভোটযুদ্ধে অবতীর্ন দু’জনই হচ্ছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের শীর্ষ ও প্রবীণ রাজনীতিক নেতা। এরা হচ্ছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি (জেলা পরিষদ প্রশাসক) এডভোকেট আসাদোজ্জামান। তিনি দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার অনুমতিপত্র নিয়ে লড়ছেন আনারস মার্কা প্রতীকে। তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বি অপরজন হচ্ছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন ভূঞা। তিনি কাপ-পিরিচ প্রতীক নিয়ে জেলা উপজেলার শীর্ষ নেতাদের সমর্থন নিয়ে প্রবল আশায় বুক বেধে ভোট যুদ্ধে অংশ নিয়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন।
নরসিংদী-৫ ( রায়পুরা) আসনের সাংসদ ও সাবেক টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সমর্থন পাওয়া প্রার্থী সাবেক জেলা পরিষদের প্রশাসক এড. আসাদোজ্জামানকে নিয়ে মাঠে নেমেছেন।
আর জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক আব্দুল মতিন ভুইয়াকে নিয়ে মাঠে আছেন নরসিংদী-১ (সদর) আসনের সাংসদ ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম (বীরপ্রতীক)। এছাড়া জেলা নেতাদের মনেনীত প্রার্থী বলেও জানিয়েছেন একাধিক ভোটার।
এবারের নরসিংদী জেলা পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরে মুল আলোচনার বিষয় হচ্ছে সাবেক টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলামের রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার ও অস্তিত্বের যুদ্ধ। ভোট প্রয়োগে এই হিসাবটি মুখ্য ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দলীয় নেতা-কর্মীরাও একই হিসাব কষে কোনো না কোন প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন।
১৮৮৪ সালে নরসিংদী জেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয়। ৭১টি ইউনিয়ন পরিষদ, ছয়টি পৌরসভা ও ছয়টি উপজেলা পরিষদ নিয়ে নরসিংদীর জেলা পরিষদ গঠিত। এখানে মোট ভোটার ৯৯৩ জন। এরমধ্যে পুরুষ ৭৬৩ জন আর নারী ভোটার ২৩০ জন। আগামী ২৮ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ১৩২ বছর পর প্রথমবারের মতো নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও জনপ্রতিনিধি পেতে যাচ্ছে জেলা পরিষদ। ভোট হবে ১৫টি কেন্দ্রে। নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ২ জন, ১৫টি সদস্য পদের বিপরীতে ৫৪ জন ও ৫টি সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদে ১৫ জন প্রতিদ্বন্ধীতা করছেন।
দলীয় সূত্র জানায়, আওয়ামীলীগ এর আগের শাসনামলে রাজিউদ্দিন আহমেদ শুধু মন্ত্রী ছিলেন না, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি ম-লীর সদস্যও ছিলেন। এই জেলায় তিনি ছাড়া আর কোনো সাংসদ মন্ত্রীত্ব পাননি। সব মিলিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের একক নিয়ন্ত্রণ ছিল তাঁর হাতে। সে সময় থেকে আসাদোজ্জামান ছিলেন রাজিউদ্দিনের আনুগত্য। সাবেক এই মন্ত্রীর অনুগত্য হওয়ার কল্যানে আসাদোজ্জামানকে জেলা পরিষদের প্রশাসকের পদে বসানো হয়। এবার ক্ষমতায় আসার পর রাজিউদ্দিন সাংসদ নির্বাচিত হলেও মন্ত্রীত্ব ও দলের সভাপতি ম-লীর পদটি হারান। এবার জেলার সাংসদদের মধ্যে একমাত্র মন্ত্রী হন নজরুল ইসলাম। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদটিও তাঁর হাতে। জেলার নেতৃত্ব নিয়ে ওই দুই নেতার মধ্যে রয়েছে চরম দ্বন্দ্ব । নজরুল ইসলামের পদোন্নাতি রাজি উদ্দিনের প্রভাব খর্ব হওয়ার পর থেকেই শুরু দন্ধ। স্থানীয় রাজনীতির এমন হিসাব-নিকাশের মধ্যে জেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হিসেবে আসাদুজ্জামান জেলা আওয়ামী লীগের পছন্দের তালিকায় ছিলেন না। শেষে পর্যন্ত নানা বিবেচনায় কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক আসাদুজ্জামানই দলীয় মনোনয়ন পান। স্থানীয় রাজনীতির হিসাব-নিকাশের কারণে মন্ত্রী নজরুল ইসলাম ও তাঁর পক্ষের নেতা-কর্মীরা আসাদোজ্জামানকে মেনে নিতে পারেননি। শেষে জেলা সাধারন সম্পাদক মতিন ভূইয়াকে প্রার্থী করানো হয়। নয়তো আসাদোজ্জামানই একক প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্ধন্ধিতায় নির্বাচিত হতো।
জ্যেষ্ঠ ও প্রভাবশালী দুই নেতার অবস্থান স্পষ্ট হওয়ার পর জেলার অন্য সাংসদরাও কোনো না কোন পক্ষভূক্ত হয়ে পড়েন। এরমধ্যে নরসিংদী-৪ (বেলাব-মনোহরদী) আসনের সাংসদ নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন মতিন ভূঞার পক্ষ নেন। আবার আসাদুজ্জামানের পক্ষে রয়েছেন নরসিংদী-৩ (শিবপুর) আসনের সাংসদ সিরাজুল ইসলাম মোল্লা। তবে নরসিংদী-২ (পলাশ) আসনের সাংসদ কামরুল আশরাফ খানের অবস্থান এখনো অস্পষ্ট।
আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থী এ্যাডভোকেট আসাদোজ্জামান বলেন, আমি দলীয় সমর্থন পাওয়া প্রার্থী। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার পছন্দের একজন হিসেবে আমি সমর্থন পেয়েছি। কিন্তু নেত্রীর চাওয়া আমলে নেননি প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম। নিজের স্বার্থে তিনি আমার বিরুদ্ধে দলের সাধারণ সম্পাদককে প্রার্থী করেছেন। এখন ওয়াজ ও মিলাদ মাহফিলের নামে কৌশলে এলাকায় এসে প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। এতে আচরণবিধি লঙ্ঘন হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। এছাড়া আমার সমর্থকদের বাড়িতে হামলা, ভাংচুর, গুলি ও হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। এর সুষ্ঠু বিচার চাই এবং একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চাই।
তবে এই ব্যাপারে জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি ও পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনে জয় পেতে প্রধানমন্ত্রীর নাম ব্যবহার অপকৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী নিজেও চান নির্বাচন হোক। যেহেতু তিনি নির্বাচন চেয়েছেন সেই কারণেই মতিন ভূঞা প্রার্থী থেকে গেছেন। তা না হলে একই দলের দুই প্রার্থী হবার কোনো সুযোগ নেই। আচরণবিধি লঙ্ঘন করার অভিযোগও তিনি অস্বীকার করেন।
বিদ্রোহী প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন ভূঞা নিজেকে বিদ্রোহী প্রার্থী ভাবতে নারাজ। তিনি বলেন, আসাদোজ্জামান দলীয় সমর্থন পেলেও পরে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। এরপর দলের সবার জন্য নির্বাচন উন্মুক্ত হয়ে যায়। প্রতিপক্ষ প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে মতিন ভূঞা বলেন, আসাদোজ্জামান প্রশাসকের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় বিশেষ একটি উপজেলাবাসী উপকৃত হয়েছে। বিষয়টি স্পষ্ট করে বলেন, বরাদ্দের ৯০ ভাগ ব্যয় করেছেন তিনি রায়পুরা উপজেলায়। কারণ ওই উপজেলার সাংসদ হলেন রাজিউদ্দিন আহমেদ।
সাবেক মন্ত্রী রাজি উদ্দিন আহমেদ বলেন, আসাদোজ্জামান দল ও প্রধানমন্ত্রীর প্রার্থী। আওয়ামীলীগের ত্যাগী ও প্রকৃত নেতা-কর্মীরা দলীয় সভানেত্রীর মনোনীত প্রার্থীতে বিজয়ী করতে মাঠে নেমেছে। সেই কারণে আমি দলের প্রার্থীর সঙ্গে আছি। সেই হিসেবে মতিন ভূঞা দলটির বিদ্রোহী। বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নেওয়া নেতাদের বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।