নিজস্ব প্রতিবেদক,বর্তমানকণ্ঠ ডটকম: দেশের সকল স্বাধিকার আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৬৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আগামীকাল বুধবার। এর ফলে ৭০ বছরে পা রাখবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাংলা ও বাঙালীর স্বাধীনতা ও স্বাধিকার অর্জনের লক্ষেই মূল দল আওয়ামী লীগের জন্মের এক বছর আগেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল গৌরব ও ঐতিহ্যের এ ছাত্র সংগঠনটি।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি একঝাঁক মেধাবী তরুণের সমন্বয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেরণা ও পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সংগঠটি। তার নেতৃত্বেই ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে আনুষ্ঠানিকভাবে এর যাত্রা শুরু হয়।
৬৯ বছরে ছাত্রলীগের অর্জন হচ্ছে জাতির ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা, মুক্তির স্বপ্ন বাস্তবায়ন, স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনা, গণতন্ত্র প্রগতির সংগ্রামকে বাস্তবে রূপদান। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সংগ্রামে ছাত্রলীগ নেতৃত্ব দিয়েছে এবং চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে।
সংগঠনটির ৬৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীটি উৎসবমুখর ও আনন্দঘন করতে সাজ-সজ্জাসহ নানা ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে সংগঠনটির নেতৃবৃন্দ। সেই সাজের ছোঁয়া লেগেছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ভবনের প্রতিটি দেয়ালে। তুলে ধরা হয়েছে সংগঠনটির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ‘চিত্রপটে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা গেছে, রোকেয়া হলের দেয়ালে আকাঁ হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সজীব ওয়াজেদ জয়ের ছবি।
এছাড়া বর্তমান সরকারের ডিজটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ও ফুটে উঠেছে ছবিতে। আছে কোমলমতি শিশুদের বই উৎসবের চিত্র। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সাক্ষী বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। এসবও নানা স্লোগান আর চিত্রে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি কার্জন হলে বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। চিত্রে সেই কথাও উঠে এসেছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা অধিকার আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সকল আন্দোলন সংগ্রামে ভূমিকা পালন করেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। দেয়াল চিত্রে এসব বিষয়ও উঠে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আরিফুল রহমান লিমন ব্রেকিংনিউজকে জানান, ছাত্রলীগের কর্মীরা রং তুলি দিয়ে এই ছবিগুলো অংকন করেছে।
তিনি বলেন, ‘সংগঠনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তুলে ধরতে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রথমবারের মতো দেয়াল চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। মূলত নতুন প্রজন্ম ছাত্রলীগের ইতিহাস জানতে পারবে।’
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন।
দেশেকে নিরক্ষরমুক্ত করতে সংগঠনের সকল কর্মীদেরকে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমরা দেশেকে নিরক্ষরমুক্ত করতে চাই আর এই কর্মসূচি পূরণ করতে সংগঠনের সকল কর্মীদের কাজ করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিবারে ন্যায় এবারও প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী র্যালি হবে। র্যালিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শাহবাগ হয়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ কার্যালয়ে গিয়ে শেষ হবে। এতে সাময়িক যানজট হতে পারে সেজন্য রাজধানীবাসীর কাছে অগ্রীম দুঃখ প্রকাশ করছি।’
প্রতিষ্ঠার দিনকে উৎসবমুখর করতে নয়টি উপ-কমিটি করা হয়েছে ও ইতোমধ্যে প্রায় সকল ধরনের প্রস্তুতি শেষ হয়েছে বলে জানান ছাত্রলীগের সভাপতি মো. সাইফুর রহমান সোহাগ।
তিনি বলেন, ‘দেশের সকল স্বাধিকার আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া প্রিয় সংগঠন ছাত্রলীগ। মুক্তিযুদ্ধে ১৭ হাজার নেতাকর্মী আত্মহুতি দিয়ে দেশের জন্য, সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। এই সংগঠন শুধুমাত্র ছাত্রসমাজের নয়, দেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রিয় সংগঠন। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের সঙ্গে দেশের সকল মানুষকে সংযুক্ত করে আনন্দ ভাগাভাগি করতে চাই।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিশন মধ্যম আয়ের দেশ গড়ার লক্ষকে সামনে রেখে ছাত্রলীগ ২০১৭ সালে দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করতে কাজ করবে সংগঠনের সকল নেতাকর্মীরা বলে জানান তিনি।
চারদিন ব্যাপী অনুষ্ঠানের কর্মসূচি:
বুধবার সকাল সাড়ে ৬টায় ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে।
সকাল ৮টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে প্রতিষ্ঠানবার্ষিকীর কেক কাটা হবে। এর পরে সকাল ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী র্যালি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে।
৫ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে রক্তদান কর্মসূচি, ৬ জানুয়ারি শুক্রবার বিকালে স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে শীতকালীন বস্ত্র বিতরণ এবং পরে টিএসসি মিলনায়তেনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।
এছাড়াও ৮ জানুয়ারি সকাল ১০টার দিকে কলাভবনের সামনে শিশু ও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা হবে।
১৯৪৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল হিসেবে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগে’র আত্মপ্রকাশ ঘটে, যা পরে আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে এ দেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়। এ প্রেক্ষাপটে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বাঙালী জাতির ইতিহাসে বিশেষ তাৎপর্য্যপূর্ণ।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে বাঙালীর ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা, ৫৪-র সাধারণ নির্বাচনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ পরিশ্রমে যুক্তফ্রন্টের বিজয় নিশ্চিত, ৫৮-র আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ৬২-র শিক্ষা আন্দোলনে ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা, ৬৬-র ৬ দফা নিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া, ৬ দফাকে বাঙালী জাতির মুক্তির সনদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা, ৬৯-র গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে পাক-শাসকের পদত্যাগে বাধ্য করা এবং বন্দী দফা থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি, ৭০-র নির্বাচনে ছাত্রলীগের অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে ছাত্রলীগের অংশগ্রহণ, স্বাধীনতা পরবর্তী সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র উত্তোরণসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রলীগের অসামান্য অবদান দেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দেয়া সংগঠনের নেতাকর্মীরা পরে জাতীয় রাজনীতিতেও নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এখনও দিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমান জাতীয় রাজনীতির অনেক শীর্ষ নেতার রাজনীতিতে হতেখড়িও হয়েছে ছাত্রলীগ থেকে। তবে সংগঠনটি চলার পথ অনেক ক্ষেত্রে কুসুমাস্তীর্ণও ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই সংগঠনটি বড় ধরনের ভাঙ্গনের কবলে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখা তৎকালীন ছাত্রলীগের বেশ ক’জন শীর্ষনেতা সংগঠন ছেড়ে ১৯৭২ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) নামে নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। ওই সময় জাসদ ছাত্রলীগ নামে আলাদা ছাত্র সংগঠনও গড়ে ওঠে, যা আজ ছাত্র রাজনীতির মাঠে সক্রিয়। এরপরও কয়েক দফায় ভাঙ্গা-গড়ার কবলে পড়তে হয়েছে সংগঠনটিকে।