মোস্তাফা জব্বার : বাংলাদেশে কম্পিউটার আসে ১৯৬৪ সালে। খুব সংগত কারণেই আমেরিকার বানানো কম্পিউটার ছিল সেটি। আসলে সেটি আমেরিকার অনুদান ছিল। এরপর ডেস্কটপ পিসির জগতে আমরা প্রবেশ করেছি আমেরিকা, জাপান, তাইওয়ান, কোরিয়া ইত্যাদি দেশের কম্পিউটার দিয়ে। ৮৭ সালে আমি আমেরিকার কম্পিউটার দিয়ে বাংলা পত্রিকা প্রকাশ করি। এরপর কম্পিউটার আমদানি সহজতর করার জন্য ৯৭-৯৮ সালে আমরা এর ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার করি। এখনো বিদেশি কম্পিউটারই আমাদের প্রধান বা একমাত্র ভরসা।
আমরা নিজেরা মনে করে আসছি যে, জটিল যন্ত্র কম্পিউটার আমরা বানাতে পারব না, বিদেশ থেকে এইসব যন্ত্র আমদানি করব এবং এর মাঝে সফটওয়্যার উন্নয়নের দিকে আমরা মনোযোগী হব। এত দিন আমাদের প্রধান লড়াই ছিল দেশ-বিদেশের জন্য কম্পিউটারের সেবা ও সফটওয়্যার উদ্ভাবনের দিকে। এতে আমাদের অগ্রগতি উল্লেখ করার মতো। তবু আমাদের নিজেদের বাজারে আমরা তেমন সফলতা অর্জন করতে পারিনি। অন্যদিকে যে খাতে আমাদের মোটেই অগ্রগতি নেই সেটি হচ্ছে দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের হাতে কম্পিউটার তৈরি হচ্ছিল না। তবে এখানে বলে রাখা ভালো বাংলাদেশের ডেস্কটপ কম্পিউটারের বিষয়টিতে একটি ভিন্ন মাত্রা বিরাজ করে। বেসরকারি খাতে যেসব কম্পিউটার বিক্রি হয় তার সবই বাংলাদেশের কম্পিউটার বিক্রেতারা সংযোজন করেন। বিদেশ থেকে যন্ত্রাংশ আমদানি করে আমরা এসব কম্পিউটার বানাই। তবে সরকার যখন ডেস্কটপ কম্পিউটার কেনে তখন বিদেশি ব্র্যান্ডের কম্পিউটারই কেনে। ল্যাপটপ সংযোজনের ক্ষেত্রে তেমন সফলতা না পাওয়ায় ল্যাপটপের বাজার বিদেশি কোম্পানির দখলেই থেকে যায়। তবে স্মরণ করা উচিত যে, দেশের প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাটা পুরোই ভিন্ন। অন্তত ২০১১ সাল থেকে তিনি নিজের দেশের ল্যাপটপ নিজের দেশের বাজারে দেখতে চাইছিলেন। তিনি সেই ল্যাপটপ রপ্তানির স্বপ্নও দেখছিলেন।
‘আমরা বাংলাদেশে কম্পিউটার বানাব এবং সেই কম্পিউটার বিদেশে রপ্তানি করব।’ স্বপ্ন, ইচ্ছা, নির্দেশনা বা আদেশ যাই বলি না কেন, এটি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বাংলার স্বর্ণকন্যা শেখ হাসিনার বক্তব্য। ৬ আগস্ট, ২০১৫ ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের সভায় এই কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমি আগেই বলেছি, এমন স্বপ্নটা তিনি ২০১১ সালেও দেখেছিলেন, যখন তিনি বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য ‘দোয়েল’ ল্যাপটপ উদ্বোধন করেন। পরনির্ভরশীল একটি দেশকে স্বনির্ভর করার এমন অদম্য ইচ্ছা বাংলাদেশের আর একজন মাত্র সরকারপ্রধানের ছিল- তিনি তারই পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দুর্ভাগ্যক্রমে বঙ্গবন্ধু সেই পরিমাণ সময় পাননি, যাতে তিনি বাংলাদেশকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশে পরিণত করতে পারেন। তবে আমাদের সৌভাগ্য যে বঙ্গবন্ধুকে হারানোর একুশ বছর পর আমাদের সোনার মেয়ে শেখ হাসিনা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পালন করা শুরু করেন। শুধু কম্পিউটার বানানোর স্বপ্নের কথা কেন বলব, তথ্যপ্রযুক্তির সকল খাতে সমৃদ্ধি বা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন কিংবা নিজের টাকায় পদ্মা সেতু বানানোর যেসব দুঃসাহসী কাজ তিনি করে চলেছেন, তাতে তার দেখানো পথেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রচিত হবে- এটি বলতে আমার নিজের কোনো দ্বিধা নেই। দেশবাসীরও নেই।
আমি ২০১৫ সালের ৬ আগস্ট অনুষ্ঠিত পুনর্গঠন করা ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের প্রথম সভার একটু স্মৃতিচারণা করতে চাই। সেদিন তিনি কম্পিউটার বানানোর ও রপ্তানির কথা বলেন। যেহেতু আমি সেই সভাতে উপস্থিত ছিলাম সেহেতু এর প্রেক্ষিতটির বিবরণও আমি দিতে পারি। সেদিন অনেক সময় ধরে তথ্যপ্রযুক্তির সামগ্রিক বিষয় নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা হচ্ছিল। চমৎকার এজেন্ডা ছিল সভার। এজেন্ডার বিপরীতে প্রধানমন্ত্রী বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্তও দিচ্ছিলেন। সভা প্রায় শেষ স্তরে ছিল। আমি তার অনুমতি নিয়ে একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার সুযোগ পাই। আমি তাকে জানাই যে, আমরা শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তরের কথা বলছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি নিজে প্রত্যাশা করেন যে, আমাদের সকল ছাত্রছাত্রী ল্যাপটপ হাতে নিয়ে স্কুলে যাবে। আপনি যদি সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপায়িত করতে চান তবে এখনকার পরিস্থিতিতে আপনাকে কমপক্ষে ৪ কোটি ডিজিটাল ডিভাইস আমদানি করতে হবে। প্রতিটি ল্যাপটপের দাম যদি ৩০ হাজার টাকা করেও হিসাব করেন তবে একটু ভেবে দেখুন এর ফলে আমরা কি পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা এই খাতে বিদেশে পাঠাব। আমাদের উচিত আমদানিকারক থেকে উৎপাদক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা।
আমার প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী কোনো মন্তব্য করার আগেই অনেকে বললেন, বাইরে থেকে আমদানি করলে কম্পিউটারের দাম কম পড়ে। আমরা দোয়েল করে ব্যর্থ হয়েছি, সেটিও অনেকে বললেন। প্রধানমন্ত্রী সবাইকে উজ্জীবিত করে তখন বলেন, আমরা কম্পিউটার বানাব ও রপ্তানিও করব। তিনি টেশিসের দায়িত্ব আমার হাতে দেওয়ার নির্দেশও দিলেন। ঘটনাচক্রে বিষয়টি সেই সভার মিনিটস-এ আসেনি। তবে প্রধানমন্ত্রীর এই স্বপ্ন আমার মতো আরো অনেকের কাছে একটি প্রয়োজনীয় ও বাস্তবিক উদ্যোগ বলে মনে হয়।
আশির দশক থেকে এখন অবধি বাংলাদেশি ব্র্যান্ডের কিছু কম্পিউটারের খবর আমরা জানি। কয়েকটির কথা আমি স্মরণ করতে পারি। বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সাবেক মহাসচিব মুনিম হোসেন রানার এক্সেস পিসি, বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সাবেক সভাপতি সবুর খানের ড্যাফোডিল পিসি, বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সদ্য সাবেক সভাপতি এ এইচ এম মাহফুজুল আরিফের সিএসএম, ফ্লোরা লিমিটেডের ফ্লোরা পিসি ও আনন্দ কম্পিউটার্সের আনন্দ পিসিসহ অনেকেই নানা নামে ক্লোন পিসি বাজারজাত করেছেন। বেসরকারি ক্রেতাদের ডেস্কটপ পিসির বাজারটা প্রধানত ক্লোন পিসির দখলে। যদিও আমাদের নিজস্ব একটি ব্র্যান্ড গড়ে ওঠেনি তথাপি ডেস্কটপ পিসির জগতে আমাদের নিজেদের হাতে সংযোজন করা পিসির দাপটই প্রধান। কেবলমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো গুণগত মানের নামে ব্র্যান্ড পিসি কিনে থাকে। এই হীনম্মন্যতার জন্য কোনো দেশীয় ব্র্যান্ড বিকশিত হতে পারেনি। তবে বেসরকারি খাতে ব্র্যান্ড ডেস্কটপ পিসি কেউ কেনে না।
ল্যাপটপ যখন জনপ্রিয় হতে থাকে তখন ডেস্কটপ পিসির এই বাজার সংকুচিত হতে থাকে। ল্যাপটপের কোনো ক্লোন দেশে তৈরি হচ্ছিল না। তবে ব্যতিক্রম হচ্ছে সরকারের টেলিফোন শিল্প সংস্থার দোয়েল ল্যাপটপ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দোয়েল তার প্রথম চালানে বদনাম কামাই করে। পণ্যের গুণগত মান নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন ওঠে। এর বাইরেও দোয়েলের ব্যবস্থাপনা নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন দেখা দেয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ দোয়েল ল্যাপটপ কিনে অনেক ক্ষেত্রে ব্র্যান্ড ল্যাপটপ-এর চেয়েও ভালোভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। কিন্তু সেই যে একবার বদনাম কামাই করা হলো তার ফলে দোয়েল বেসরকারি ক্রেতাদের কাছে কোনো আকর্ষণই তৈরি করতে পারল না। অন্যদিকে সরকারি কেনাকাটায় প্রথমেই বলা হয়ে থাকে যে, আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত ব্র্যান্ড হতে হবে। দোয়েল সেই সীমা অতিক্রম করতে পারে না- কারণ সেটি আন্তর্জাতিক খ্যাতি জোগাড় করতে পারেনি। বাজারজাতকরণে এই প্রতিষ্ঠানটির মারাত্মক দুর্বলতাও এ জন্য চরমভাবে দায়ী। এই বিষয়টি আমরা অন্য কোনো সময়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করতে পারি। যাই হোক, বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নিজের দেশে ডিজিটাল ডিভাইস উৎপাদন করা।
এটি অত্যন্ত আনন্দের যে, সেই চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেছে বাংলাদেশের প্রখ্যাত ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস শিল্পপ্রতিষ্ঠান ওয়ালটন। তারা তাদের গৃহস্থালি পণ্যের সারিতে যুক্ত করেছে ল্যাপটপ। ২০টি মডেলের এক বিশাল বৈচিত্র্যময় জগৎ গড়ে তুলেছে তারা। গত ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি হোটেলে এই ল্যাপটপগুলোর উদ্বোধন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অনুষ্ঠানে তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলকও উপস্থিত ছিলেন। আমিও ছিলাম সেই অনুষ্ঠানে। অর্থমন্ত্রী ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী এই উদ্যোগের প্রশংসা করার পাশাপাশি বেশ কিছু দিকনির্দেশনাও প্রদান করেন। ওয়ালটনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম শামসুল আলম, পরিচালক এস এম রেজাউল আলম এবং কর্মকর্তা লিয়াকত হোসেন ওয়ালটন ল্যাপটপের বিবরণসহ বাজারজাতকরণের পরিকল্পনাও পেশ করেন।
আমি নিজে মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আমরা কিছু অতি প্রয়োজনীয় উদ্যোগের প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি। যেসব প্রসঙ্গ আমি এখানে আলোচনা করছি তার প্রায় সবগুলোই আমি ওয়ালটনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করেছি।
ক) স্থানীয় উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে বাইরে থেকে আমদানি করা সম্পূর্ণ উৎপাদিত কম্পিউটার পণ্যের ওপর করারোপ ও ভ্যাট আদায় করা যায়। যন্ত্রাংশ বা কাঁচামাল শুল্ক ও ভ্যাটমুক্ত করা যায়। এতে দেশের রাজস্ব বাড়বে এবং ডিজিটাল যন্ত্র দেশে উৎপাদিত হবে। বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।
খ) সফটওয়্যারের মতো হার্ডওয়্যার উৎপাদনও আয়কর সুবিধা প্রদান করা যায়।
গ) সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদেশি ব্র্যান্ড কেনার বদলে দেশীয় ব্র্যান্ডের ডিজিটাল ডিভাইস কেনার বিধান করা যায়। এর মান পরীক্ষা করার দায়িত্ব আইসিটি ডিভিশন নিজেই নিতে পারে।
ঘ) ডিজিটাল পণ্য উৎপাদনের জন্য আধুনিক মানের প্লান্ট স্থাপন করতে হলে প্রয়োজন সুবিধাজনক জমি। তাই আমরা আশা করব সকল ইউটিলিটি সুবিধা দিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্মাণাধীন হাইটেক পার্কে এ জন্য উৎপাদক কোম্পানিগুলোকে পর্যাপ্ত জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হবে।
ঙ) স্থানীয় বাজারে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করার স্বার্থে ভোক্তা পর্যায়ে এসব পণ্যকে সহজলভ্য করে তুলতে হলে দেশি উৎপাদিত পণ্য খুচরা পর্যায়ে সরবরাহ ও বিক্রির ক্ষেত্রে সকল প্রকার ট্যাক্স ও ভ্যাটমুক্ত রাখতে হবে।
চ) একইভাবে এই খাতকে পোশাকশিল্প খাতের মতো সমৃদ্ধ করতে হলে দেশে উৎপাদিত আইটি পণ্যের রপ্তানির ক্ষেত্রে অন্তত ১০ শতাংশ ক্যাশ ইনসেনটিভ চালু করতে হবে।
আমি এই প্রতিবেদনটি লেখার সময় সর্বশেষ যে তথ্যাদি পেয়েছি সেটি সত্যিই উৎসাহব্যঞ্জক। এরই মাঝে ওয়ালটন তার প্রথম চালানটি বিক্রি করে দ্বিতীয় চালানও বিক্রি করতে শুরু করেছে। আমি তাদের পণ্যের যে মূল্য দেখেছি তা বিদেশি ল্যাপটপের চেয়ে অন্তত শতকরা ২৫ ভাগ কম। তার চেয়েও বড় বিষয় যে, ওয়ালটন তাদের ল্যাপটপ কিস্তিতেও বিক্রি করছে। ফলে আমরা দেশের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের হাতে ল্যাপটপ তুলে দেওয়ার যে স্বপ্ন দেখছি বা দেশের প্রধানমন্ত্রী যে স্বপ্ন দেখছেন, তা বাস্তবায়িত হবেই।
নিবন্ধটি শেষ করার আগে আমি ওয়ালটনের কাছে ৭ থেকে ১০ ইঞ্চি ট্যাব বাজারজাত করার অনুরোধও করব। কারণ ট্যাবও বহু ক্ষেত্রে ডিজিটাল ডিভাইস হিসেবে ব্যবহার করার চমৎকার একটি যন্ত্র।
লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কি-বোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক